বর্ণালোক দ্বিমাসিক পত্রিকা

বর্ণালোক দ্বিমাসিক পত্রিকা

রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২০

 সম্পাদকীয়-- 

বর্ণালোক আমাদের প্রথম অনুগল্পের ব্লগ ও ই-পত্রিকা। এটি এটি দ্বিমাসিক পত্রিকা। এখানে নবীন-প্রবীণ লেখকদের লেখা পরিবেশিত হয়েছে। তাদের বর্ণলিপিতেই আলোকিত হয়েছে আমাদের এই পত্রিকা।  করোনাকালে অনেক প্রিন্ট পত্রিকা, পিডিএফ, ব্লগ পত্রিকায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে অনলাইন পত্রিকার জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। প্রিন্ট বই বা পত্রিকা কিনে পড়ার অভ্যাস আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি। তবে ই-পত্রিকা স্বল্প দামে কিনতে হয়, অনলাইন পত্রিকার  লিংক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিনে নিয়ে পড়তে হয়।  

আমাদের ই-পত্রিকা ও ব্লগ পত্রিকা ফ্রী--যে কেউ পাতা উল্টে লিঙ্কে ক্লিক করে পত্রিকা পড়ে নিতে পারেন। শেষে বলব, এই করোনা মহামারির অকালে আমাদের রহন-সহন অভ্যাস সব কিছুই পাল্টে যাচ্ছে, আর এটাই তো স্বাভাবিক। এক দিকে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে মানুষের স্বভাব চরিত্র আচার-আচরণ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, মুখে মাস্কহাতে গ্লোভস, আর সোশ্যাল ডিসটেন্স মেনে চলতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। অবস্থা মানুষকে পাল্টায়। দেশের তথা পৃথিবীর এই বদ্ধমন পরিবেশ থেকে মানসিক নিজাত পাওয়ার যে উপায়গুলি আছে তার মধ্যে গল্প-কবিতা সাহিত্যের মাঝে কিছু সময় আসুন না আমরা ডুবে থাকি। বইয়ের জগৎ আমাদের ঘরের বাইরে টেনে আনে। বদ্ধ ঘরের ভাবনা থেকে আমাদের মুক্তি দেয়। তাই আসুন আজ আমরা বন্ধমন খুলে পাঠাভ্যাসে অভ্যস্ত হই।  অনেক সাহিত্য পাঠের মধ্যে আমাদের বর্ণালোককে  একবার খুলে দেখতে অনুরোধ থাকলো। ধন্যবাদান্তে--

সম্পাদক--তাপসকিরণ রায় 

সহ সম্পাদক--সমীর কর্মকার ও সাবিত্রী দাস।

 

সূচিপত্র-- 

 

তৈমুর খান, সোনালী মিত্র, কৌস্তুভ দে সরকার, নির্মাল্য বিশ্বাস, সাবিত্রী দাস, লুতফুল বারি পান্না, সোমনাথ বেনিয়াঅগ্নিশ্বর সরকার, সুস্মিতা দেবনাথ, ইন্দ্রানী বন্দ্যোপাধ্যায়, ডক্টর অরুণ চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়, উশ্রী মন্ডল, বাণী  মন্ডল, প্রতিমা বিশ্বাস, চন্দ্রানী বসু, সত্যরঞ্জন গিরি, উৎপল পাল, স্মৃতি শেখর মিত্র, শংকর ব্রহ্ম, কাবেরী তালুকদার, মৌ ঘোষ, জয়া গোস্বামী, তমা কর্মকার, জেবুন্নেসা হেলেন, রুপালি মুখোপাধ্যায়, সুস্মিতা সরকার, বহ্নিশিখা, মনীষা কর বাকচি, শমিত কর্মকার, তাপসকিরণ রায়।

 


 



                                 কালাচাঁদ 

                                তাপসকিরণ রায় 

 

--হারামজাদী, এগুলি রুটি, না আটার দলা ? কালাচাঁদ নেশার ঘোরে টলছিল। সে ভাবেই কাছে দাঁড়ান বৌয়ের চুলের মুঠি টেনে ধরে সে, তারপর দু চারটে থাপ্পড় চড় দেবার পর ক্ষান্ত হয়। 

--কি করুম? ভেউ ভেউ কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে যমুনা। 

--আবার কথা ? চোপা !

--নাআমি কমু কমু কমু--

--তবে রে--এক মোক্ষম ধাক্কা পড়ল যমুনার গায়ে, সে ঘরের মেঝেতে ছিটকে গড়িয়ে পড়ল। প্রায়ই একটু আধটু হয়, কিন্তু আজ যেন বড় আকার নিলো। যমুনা গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল। 

--যা যা--তোর বাপের কাছে যাওই--শ্যামলালের কাছে যা--কালাচাঁদ টলতে টলতে বিছানায় গিয়ে পড়ে। মাঝ রাতে আবার সে জেগে ওঠে তখন নেশার ধুম ছুটে গেছে, খিদেয় পেট চোঁ চাঁ করে উঠেছে। 

যমুনা ঘরের মেঝেতে পড়ে শোকে দুঃখে ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। 

--এই, এই যমুনা, যমুনার কাঁধে ঠেলা দিতে থাকে কালাচাঁদ। 

--কি হইতাছে ? টের পেয়ে যমুনা ঝাঁজিয়ে ওঠে।

--খুব ভুক লাগছে রে --

--যাখা গে যা না--

--তুই বাইড়া না দিলে আমি খাইতে পারি

--খুব পারিস--

--পারি না রে, তুই না দিলে আমার খাইতে ইচ্ছা হয় না, কালাচাঁদ এখন অন্য এক মানুষ। শান্ত ভদ্র এক নিরীহ জন, নেশারু রূপ বুঝি তার এক খোলস ছিল ! সে যমুনার মাথায় কপালে হাত বুলায়--আদর সোহাগ করে। 

শুরুতে যমুনা এক ঝামটা দিয়ে পাশ ফিরে শোয়। তারপর ধীরে ধীরে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।ওদের কাছে সুখ-দুঃখের ক্ষেত্রফলগুলি একই সূত্রে গাঁথা। ওরা বুজি দুঃখে কাতর হয়ে সুখের অপেক্ষা করে আর মুহূর্তের সুখকে জীবনের ভেতর জিয়িয়ে রাখে। তাই শত দুঃখের আবর্তনের মাঝেও ওরা বেঁচে থাকতে শিখেছে !

                                               

                                           সমাপ্ত 


শমিত কর্মকার

 

                             এমন কোন দিন দেখিনি

                                     শমিত কর্মকার

 

হঠাৎ করে সে দিন রাতে মনোময়ের বাড়ি থেকে ফোন এলো, তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসো। ফোনটা করেছিল মনোময়ের কাকিমা। মনোময় বুঝতে পারছিল না কেন এমন ফোন ! তা হলে কি বাড়িতে কিছু বিপদ? ফোন তো এটুকু করেই ছেড়ে দিল--বাড়ি চলে এসো।

      মনোময়ের বাড়ি সাগরের কাছাকাছি একটি গ্রামে। সে  কলকাতায় চাকরি সূত্রে থাকে। তার উপর এক মারণ রোগ মানুষের জীবন বিপন্ন করে দিচ্ছে। মানুষ কোনটা করবে ভেবে পাচ্ছে না। মনোময়ের বাড়ি যেতে হলে সেই ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে যেতে হবে। এতো রাত্রে খবর আসায় সে একটু ঝামেলায় পড়ল, তার উপর একটা মানসিক চিন্তা কি হল, তার এ সপ্তাহে নাইট ডিউটি তার উপর সোমবার, অফিসের একটা জরুরি কাজ পড়ে  আছে সেটা যে আমাকে বুঝিয়েই বেরোতে হবে।

    মনোময় রোজ রাত ৮টার মধ্যে অফিসে চলে নাইট ডিউটি থাকলে। কিন্তু সে দিন এমন একটা ফোন আসায় সবাই গন্ডগোল হয়ে গেল। কি করবে, কি করবে না, এই ভেবে সব ঠিক করে বেরোতে দেরি হয়ে গেল। তার অফিস ডায়মন্ডহারবার রোডের উপরে  ছিল। প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকবার সময় দেখল চারিদিকে শুনশান হয়ে গেছে, কাউকে তেমন চোখে পড়ছে না ! অফিস প্রধান ফটক থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার। দুপাশে গাছ গাছালি ভরা, আধো আলো জায়গা। মনোময় দেখলো তার ঠিক আগে আগে কে হেঁটে যাচ্ছে। সে ভাবলো ভালোই হল, চারিদিকে শুধু শুনশান কাউকে তো পাওয়া গেলো। সে ভাবলো তার অফিসের বিমলদা বোধ হয়। মনোময় বিমলদা বিমলদা বলে ডাকছে আর এগোচ্ছে কিন্তু সে যত তাড়াতাড়ি হাঁটছে সামনের জনও আর জোরে হাঁটছে। মনোময় ভাবছে তাহলে কে আগের ঐ লোকটা ? বিমলদা হলে তো সাড়া দিতো। তাহলে তার আগে যাওয়া মানুষটি কে? তার শরীর ভারী হতে লাগলো। ঠিক যখন অফিসের সামনে সে দেখলো লোকটা আর নেই! মনোময় ঠিক অফিসের সামনে এসে অজ্ঞান হয়ে গেল। অফিসের যারা নাইটে ছিল ছুটে এসে তাকে ধরে জল দিতে লাগলো আর বলতে লাগলো, এমন কি হল আজ সে অজ্ঞান হয়ে গেল !

    একটু জ্ঞান ফিরতেই তার মুখ দিয়ে শুধু আওয়াজ বেরোচ্ছে, এমন তো কোন দিন দেখিনি, এমন তো কোন দিন দেখিনি ! সবাই অবাক হয়ে গেল, আজ মনোময় কি দেখেছে যে তার এমন অবস্থা হল !



মনীষা কর বাগচী

 

                                 ভালো থেকো

                                  মনীষা কর বাগচী

 

দেখতে দেখতে সময় চলে গেল ভাঁটার টানের মত। সময় তো চলে যায় কিন্তু স্মৃতিগুলো জোয়ারের জলের মত ফিরে ফিরে আসে। কিছু কিছু স্মৃতি ধূসর হয় না কোনোদিন‌ও। ম্যাপল পাতার মতো ঝরে গিয়েও রঙিন থাকে। মাটিতে অবহেলায় পড়ে থেকেও মানুষকে মুগ্ধ করে।

--হুমমমম। ঠিকই বলেছ। কেমন আছো তুমি মিষ্টি?

--যেমন থাকা যায় তোমাকে ছেড়ে তেমন আছি। ফুলের সুবাসকে ছেড়ে ফুল যেমন ভালো থাকে।

--আবার ওই সব কথা কেন? যে সময় গেছে চলে তাকে যেতে দাও না।

--সে আমি পারবো না নীল। সেই তো আমার বেঁচে থাকা। সে সুখের হোক আর দুঃখের হোক তাকে নিয়েই আমার পথ চলা। আমার একলা বেলার একমাত্র সাথী। 

-- আচ্ছা এখন কী করছ তুমি?

--ভাবছি। অনেক দিন আগের একটি কথা মনে পড়ে গেল। তুমি আমার চোখের সামনে। আনমনে গাইছ আমার প্রিয় গান "মনে রবে কিনা রবে আমারে"ইচ্ছে করছিল এক দৌড়ে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরি। তীব্র আলিঙ্গনে শীতল করে দিই তোমার আগুনরঙা যন্ত্রণাগুলিকে। কিন্তু কিছুই পারিনি। পারা যায় না। তোমাকে কোন দিন বলতেও পারিনি যত দিন এ দেহে ব‌ইবে অক্সিজেনের ধারা তত দিন‌ই মনে রবে তুমি। শুধু তুমি। তোমাকে আলিঙ্গন করা তো দূরের কথা তোমার দিকে তাকানোর‌ও অধিকার ছিল না আমার। তোমার সহধর্মিণী চায় না তাই। একটা সত্যি কথা বলব? যাকে তুমি এতো ভালোবাসো, যার জন্য তুমি আমার সঙ্গে একটু কথা বলতেও সাহস পাও না। সে তোমাকে কোন দিন ভালোবাসেনি। এক্টুয়ালি সে ভালোবাসতে জানে না। ভালোবাসা বিশ্বাস করতে শেখায়। সে যদি তোমাকে ভালোবাসতো তোমাকে অবিশ্বাস করত না। আমাকে ভয় পেত না। সত্যিকারের প্রেম ত্যাগ করতে শেখায় ছিনিয়ে নেওয়া নয়।  আমি যাকে ভালোবাসি তার ক্ষতি করতে পারিনা এতটুকুও। তার সুখের ঘরে আমি কি আগুন ধরাতে পারি ? সে যদি ভালোবাসতে জানতো তবে বুঝতো। থাক সে সব কথা। জীবন তো কেটেই গেল। জানি না তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা। তবে যদি কোন দিন দেখা হয়েই যায় সেই অমলিন হাসি যেন দেখতে পাই তোমার মুখে। "তোমারই মুখের চকিত সুখের হাসি দেখিতে যে চাই"

-- কেন দেখা হবে না? আরও অনেক বার দেখা হবে। আর কেউ আমাকে না বুঝলেও তুমি তো বোঝো। আমার প্রতিটি অণুপরমাণুর সাথে মিশে আছো তুমি। হৃদয়ের প্রত্যেকটি কোণে গড়েছি তোমার ইমারত। তোমাকে একটু দেখার কী ভীষণ আকুলতা সে যদি তুমি জানতে !

-- জানি। তবে আমি তোমার সুখের সাগরে উথালপাথাল ঢেউ হতে চাই না। ভালো থেকো তোমার ভালোবাসার সাথে।  শিশির ভেজা ঘাসের মতো ভালো থেকো।

 

                                            সমাপ্ত


বহ্নিশিখা

 

                                    গহীন মন

                                         বহ্নিশিখা

 

সন্তান নেই বলে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশি  সকাল বেলা কেউই মুখ দেখে না কমলার। আঁটকুড়ে মুখ দর্শণে দিন ভাল যায় না, তাদের । মনে মনে কষ্ট  পেলেও ঠোঁটে হাসে কমলা। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে দেখে।

বুকের ভেতর চাপা কষ্টটা বিগরে গেলে মাঝে মাঝেই সে ঈশ্বরকে খুব বকে। ঈশ্বর হয়তো চান নি সে মা হয়। নয়তো বিয়েটা স্বাভাবিকের চেয়ে দেরিতে হবে কেন? তাও আবার দোজবর। দু'সন্তানের বাবা। 

বিয়ের পর পরেই কমলা মা ডাক শুনার জন্য খুব উদগ্রীব ছিল। কিন্তু নবারুণ সতর্ক ছিল খুব। অনেক পীড়াপীড়ি করেও একরোখা নবারুণকে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি করাতে পারে নি কমলা।

এ নিয়ে অশান্তি হতে হতে এক সময় মনোপজ এরিয়ায় চলে যায়। যখন আর কিছু করার থাকে না। মাতৃত্ব সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে খানিকটা এবনরমাল হয়ে পড়ে কমলা। ভুল বুঝে নবারুণের পরিবার। 

এরপর পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। সামলে উঠেছে কমলা। কান্নাগুলো বুকের ভেতর মরে যায়। আবার জিইয়েও যায়। তখন উদাসীন ভাবে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে পথ চলতে চলতে তার দেখা হয় অনেক মায়ের সাথে, কথাও হয়। 

এই সে দিনই তো ! অনেক কথা হল এক মায়ের সাথে।  ফুরিয়ে যাওয়া সেই মা। তার মনের খবর কেউ জানতেও চায় না। অভিমান না বুঝে  অভিযোগের পাল্লা ভারী করে দূরেই ভাল থাকে সন্তানেরা। মা'রা সব বুঝে। কিছু বলে না।

কমলাই কতটুকু রাখে মা'য়ের খবর? মা'য়ের মনের খবর? সেও তো ভীষণ রকম ব্যস্ত, না পাওয়ার যন্ত্রণা যখন তাকে সার্বক্ষণ ব্যথিত করে, কখনো কি একবারও ভেবেছে

কেমন আছে সব থাকা মা'য়ের মন?  

মাঝে মাঝে দেখতে যায় কমলা। তার মাকে। নিজের প্রয়োজনটাই মুখ্য থাকে। নিরিবিলি কথা হয় না। মায়ের অনেক জমানো কথাই হয়ত গলার নীচে দলা পাকিয়ে থাকে। গিলে ফেলে সে কষ্টগুলো। বলাই হয় না।

ছোটবেলায় দেখেছে দিদিমা'র মনেও খুব কষ্ট ছিল। মা, মামারা ছিল, তবুও কষ্ট ছিল। দিদিমা খুব কাঁদতো, এখন মা"ও খুব কাঁদে। 

এই জনমে জানা হল না কমলার, মা ডাক শুনতে কেমন 

লাগে? সেও কাঁদে।

                                       সমাপ্ত



রূপালী মুখোপাধ্যায়


ক্রিয়েটিভিটি 

                           রূপালী মুখোপাধ্যায়  


বনি শশব্দের একটা গল্প লেখা শেষ করে খুব উত্তেজিত হয়ে মাকে ডাকলো , মা , ও মা তোমার রান্না শেষ হলো ? একবার এ ঘরে আসবে ? মা শুনতেই পেলো না । মায়ের মন ব্যস্ত রান্না আর এই পরিস্থিতির দুশ্চিন্তায় । 

ও মা শুনতে পাচ্ছো না ? মা ---। বনি নিজেই রান্না ঘরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বল্লো , মা গল্পটা শেষ করেই ফেললাম। শুনবে , মা শুনবে ? 

দূর , আমার এসব ভালো লাগছে না । ছাড়  , আমাকে ছাড় । 

মা , কেন তুমি এতো চিন্তা করছো মা ? আমাদের কারুর হাতে তো কিছু নেই । চিন্তা কি এমনি এমনি করছি ? কাল থেকে দাদার ফোন পাইনি , তোর বাবার যদি  টানটা বাড়ে , কোথায় নিয়ে যাবো ? কিভাবে নিয়ে যাবো ? অত ভেবে কি হবে মা ? বাবা তো এখন ভালো আছে আর তোমাকে বলতে ভুলে গেছি , দাদার সঙ্গে আমার হোয়াটসএপে  কথা হয়েছে , ভালো আছে । তোমাকে চিন্তা করতে বারণ করেছে । 

মা তুমি শুনছো না ?  সব সময় ডাক্তারবাবুরা বলছেন , "ঘরে থেকে যার যা সৃষ্টিশীল প্রতিভা আছে কাজে লাগান "। সবাই দেখছো না কবিতা লিখছে , কবিতা পড়ছে , গল্প, ছড়া লিখছে , ছবি আঁকছে । ভালো মন্দ , ঠিক বেঠিক ভাবার সময় এটা নয় মা । ভালো লাগার মতো কিছু করে সময় কাটানোই  হচ্ছে মুখ্য উদ্দেশ্য  । আমিই  পারি গল্প লিখতে , একটু ভালো লাগা  মা । 

মা ,  ও মা , তুমি তো আগে গান গাইতে , আজ সন্ধেবেলায় একটা গাইবে ? তাহলে আমি ফোনে রেকর্ড করে পোষ্ট করে দেবো , দেখবে মামা , মাসিরা অবাক হয়ে যাবে আর খুশিও হবে । এটাই কম কি মা ? 

এমন সময় পাশের বাড়ি থেকে তুমুল চিৎকার শোনা গেল , প্রায়ই শোনা যায় তবে আজকে অতিরিক্ত । গোপাল জেঠুর কিছু হলো নাকি মা ? জেঠিমার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । কি হলো মা ? ওই দ্যাখো জেঠিমা বলছে "তুমি ছেড়ে দিলে আমি কোথায় যাবো "?

আমার খুব চিন্তা হচ্ছে রে বনি  । যাওয়াও তো যাবে না । কি যে রোগ এলো বাবা , পাশাপাশি কিছু হলে কেউ কারুর খবর নিতে যাবে না ! ! এভাবে কি বাঁচা যায় ? 

মা জেঠুকে একটা ফোন করবো ?  দ্যাখ তো ধরে কি বলে। 

দেখছি দেখছি , চিন্তা করো না । 

এই তো রিং হচ্ছে , হ্যালো , হ্যালো , জেঠিমা ? শুনতে পাচ্ছেন ?  কে  বনি ? হ্যাঁ  হ্যাঁ , কি হলো আপনাদের ? এতো চিৎকার শোনা যাচ্ছে । মা তো খুব চিন্তা করছে । 

আর বলিস না,  তোর জেঠু বলল , ডাক্তাররা  বলেছেন যে যা ভালবাসে তাই করতে । তাই আমরা প্রতিদিনের মতো তোর জেঠুর  সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি করছিলাম , তবে হ্যাঁ আজ একটু বেশীই হয়ে গেছে নারে ? যাক তোরা সব ভালো আছিস তো ? ঠিক আছে রাখ।

 

জেবুননেসা হেলেন

 

                                      হাঁচি 

                                জেবুননেসা হেলেন

 

মিঠির কয়দিন যাবৎ মন খারাপ। কারণ করোনার জন্য লকডাউন চলছে। মুক্ত আকাশ, পাখি, ফুল বা নদী কিছুই দেখতে পারছে না।

মিঠি জানে নিসর্গই ওর আপন। গালে হাত দিয়ে মাঝে মাঝে সে জানালায় মুখ করে ভাবে, কবে এই কোয়ারেন্টাইনের দিন ফুরাবে !

আচ্ছা, আর এন এ এই ক্ষুদ্র ভাইরাসটার প্রতিষেধক কেন সেই ডিসেম্বর থেকেও বিজ্ঞানীরা বের করতে পারছে না?

ভাবতে ভাবতে তার অন করা ম্যাসেঞ্জারে টুক করে শব্দ হলো। মন খারাপ ভাবটা নিমেষেই উবে গেলো। ঝলমলে একখণ্ড রোদ ভেসে উঠলো ওর সারা মুখে। রোদের আলোতে এক টুকরো লজ্জাও ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসিতে দেখা দিলো।

অর্হ ! হ্যাঁ অর্হ ই তো ! বহুদিন পর তার ম্যাসেজ এলো।

ছোট্ট বেলার সাথী। কত কত দিন ওরা এক সাথে আম চুরি করেছে। কত কত দিন সারা দুপুর ঘুড়ির সূতোয় মাঞ্জা দিয়ে বিকেল গড়িয়ে গেছে।

অর্হ ! আই টি ইঞ্জিনিয়ার। কানাডা থাকে। মনে মনে মিঠি অর্হকেই ভালোবাসত। এখনও শিহরিত হয় ওকে মনে পড়লে। কিন্তু! অর্হ ! না।সে মিঠির কালো মুখের দিকে কোনো দিন ফিরেও তাকায় নি।

- হ্যালো !

ম্যাসেজ আসার সাথে সাথে মিঠি লিখলো," কেমন আছো?"

- ভালো।তোমাদের খবর বলো।

- আছি, ঘর বন্দী। বাংলাদেশে কোয়ারেন্টাইন চলছে। করোনার জন্য।

- আরে ধুর ! কিচ্ছু হবে না। মরতে তো একদিন হবেই।

অর্হর সেই সাহসী উচ্চারণ। যেন সেই কিশোর ডোন্টকেয়ার বালকটি কথা বলছে।

- তা বটে। কিন্তু অসময় মৃত্যুকে কামনা করে?

-তা ঠিক। আমাদেরও কোরেন্টাইন চলছে। ঘরে বসে অফিস করি। চিন্তাফিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

- হলেই ভালো। তো, তোমাদের রাষ্ট্র প্রধান টুডো তো তোমাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতিবব্ধ। আমাদের তো সে ব্যবস্থা নেই।

- হুম। ভেবো না। বাই। কাজে বিজি। অন্যদিন কথা হবে।

-ওকে। বাই।

মন খারাপ ভাব কমায় বই খুলে বসে মিঠি।

আব্দুল মান্নান সৈয়দ এর " জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ" খুলে পড়তে থাকে।

নানান কাজে দিন চলে যায়। প্রায় ১৬/১৭ দিন ঘরে বসে কেটে যাচ্ছে। নাহ ! কিছুতেই মন বসে না। কি এক অস্বস্থি গিলে খায় সমস্ত ভালো লাগা।

কি বার আজ ! হ্যাঁ সোমবার ! ক্যালেন্ডার ওল্টায় সে।

হঠাৎ ফোনে নেট খোলে। ফেসবুকে দু' একটি পোষ্ট পড়ে। নিজের নোটিফিকেশনের কমেন্টের জবাব দেয়।

ম্যাসেঞ্জার খুলতেই দেখে, সবুজ হয়ে আছে অর্হ।

- হ্যালো ! অর্হ ভালো আছো?

- না। ভালো নেই। সংগে সংগেই জবাব দেয় সে। যেন প্রাণহীন একপ্রস্থ শব্দ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে উঠে আসে ম্যাসেঞ্জারের বর্ণে আলোয়।

- কী হয়েছে?ফোন দিতে পারি?

-দাও।

মিঠি ফোন দেয়।কথা বলে।

- বলো কি হয়েছে?

- আমার দুই বন্ধু আমেরিকার নিউইয়র্কে থাকতো আজ ওরা  COVID -19 এর আক্রমনে মারা গেছে। দু' জনই আমার সাথে ঢাকা কলেজে পড়ত।

মনটা খুব খারাপ। দীর্ঘ এক দীর্ঘশ্বাস কুন্ডলী পাকিয়ে যেন ফোনের বায়ুতে ঘুরপাক খেতে থাকে।

- ভেরি সেড। তোমাদের ওখানে কী অবস্থা?

- ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছে।

যেন অনেক দূর থেকে কোনো ক্লান্ত পথিক ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে এভাবে কথা বলে সে।

- চিন্তা করো না। সাবধাণে থেকো।

- হুম। তোমরাও সাবধানে থেকো। আজ রাখি।

ফোন রাখতে রাখতে মিঠি শুনতে পায়, হা হা হাচ্চু!!!

হাঁচির শব্দটি মিঠিকে নির্বাক করে দেয়

 

                                         সমাপ্ত